নিজস্ব প্রতিবেদক:
চারদিকে দূষণ বিষ। বায়ু, পানি, মাটি- সবই বিষাক্ত হচ্ছে। অথচ প্রতি অর্থবছরেই বাজেটের আকার বড় হলেও পরিবেশ সুরক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয় না। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। যা এর আগের অর্থবছরের (২০২০-২০২১) চেয়ে ২৫ কোটি টাকা কম। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ পেয়েছিল ১ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। আর তার আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০২০) বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। বিগত ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে (২০১৭-২০১৮) তা ৭৩১ কোটি টাকা কমিয়ে করা হয় ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। তবে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা করা হয়েছিল। অথচ পরিবেশ ও জলবায়ুর উন্নতিই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা, লোকবল বৃদ্ধি প্রয়োজন। পরিবেশ বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবাদী সংগঠন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গত এক দশকে দেশে শিল্পায়ন বেড়েছে। ফলে নদ-নদী ও খাল-বিল দখল-দূষণের পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে বাতাস, বিস্তীর্ণ বনভূমি উজাড় হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বে বায়ু দূষণে একাধিকবার শীর্ষে উঠে এসেছে রাজধানী ঢাকা। আর মাত্রাতিরিক্ত কল-কারখানা আর যানবাহনের কারণে শব্দদূষণও বাড়ছে। উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্বের দেশ হিসেবে এদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় সঠিক পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে।
সূত্র জানায়, পরিবেশের সঙ্গে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির সুনির্দিষ্ট ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে ৪টি অভীষ্ট সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তার মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবেশ ও জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনা, শতভাগ জনগোষ্ঠীকে বিশুদ্ধ পানির আওতায় আনা, নবায়নযোগ্য জ¦ালানি নিশ্চতকরণ ও সমুদ্র দূষণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অন্তর্ভুক্ত। এলডিসি উত্তীর্ণ হতে হলে সরকারকে এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট) বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিবেশ দূষণ অব্যাহত রেখে এসডিজি অর্জন অসম্ভব। শুধু পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না। শিল্প মন্ত্রণালয়কেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যাতে শিল্প মালিকরা সঠিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে। সর্বোপরি পরিবেশ রক্ষায় বাজেটে বরাদ্দ ও ব্যাপকতা বাড়াতে হবে।
সূত্র আরো জানায়, পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ২ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট। এসময়ে বিশ্বব্যাপী মারা গেছেন প্রায় ৯০ লাখ মানুষ। দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। আর ২০২০ সালে এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স (ইপিআই) অনুযায়ী, চরম ঝুঁকিপূর্ণ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল একেবারে শেষে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেটে বরাদ্দ কমেছে। অথচ পরিবেশ রক্ষায় নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
এদিকে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবেশ খাতের উন্নয়নের অন্যতম শর্তই হচ্ছে পর্যাপ্ত গবেষণাগার। যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করা যাবে এবং ওই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে। কৃষির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব তা থেকে উত্তরণ ও আগাম ফসল প্রস্তুতিতেও বরাদ্দের অর্থ প্রয়োজন পড়বে। বর্তমানে বাজেটের আকার অনেক বড় হলেও পরিবেশের জন্য বরাদ্দ পর্যাপ্ত বাড়ানো হচ্ছে না। বরং পরিবেশের ভেতরে অন্যান্য জিনিসগুলোও এমনভাবে দেয়া হচ্ছে যা আসলে পরিবেশের না। উন্নয়ন কর্মকা- বা অবকাঠামোর বরাদ্দকে পরিবেশে দেয়া হচ্ছে। অথচ পরিবেশের জন্য প্রয়োজন বাজেটে টেকসই বরাদ্দ। আসন্ন বাজেটে পরিবেশের জন্য অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। আর নবায়নযোগ্য জ¦ালানি গবেষণা ও উৎপাদনে ওই বরাদ্দের ৩০ ভাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। পাশাপাশি সবুজায়ন বাড়ানোর জন্য সারাদেশে ১০ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করা যেতে পারে। বর্তমানে দেশে যে হারে শিল্পায়ন বাড়ছে সেক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিয়নে পানি শোধনাগার প্রয়োজন। যা পানিকে পরিশোধন করে খাল-বিলে ফেলবে। আর তা করা হলে এদেশের কৃষি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।
অন্যদিকে বাজেটে পরিবেশ সুরক্ষা খাতেন বরাদ্দ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জানান, নানামুখী শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, এক দশক আগেই ঢাকার চারপাশে নদীগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ দূষিত হয়ে পড়েছে। এখন সারাদেশে যেভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাতে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতাও বাড়ানো দরকার। কিন্তু বিগত অর্থবছরের বাজেটে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ আরো কমানো হয়েছে। অথচ পরিবেশ সংরক্ষণে মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা, লোকবল বাড়াতে বড়সড় বরাদ্দ প্রয়োজন। কেননা এখনো দেশজুড়ে ব্যাপকহারে শিল্পায়ন হচ্ছে। এমন অবস্থায় বাজেটে যদি সঠিক বরাদ্দ না থাকে তাহলে বুঝতে হবে তা টেকসই বাজেট না। তবে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আগামী ৯ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করবেন। দেশের ৫১তম এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ২২তম ওই বাজেটে দেশের অবকাঠামো, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও কর্মসংস্থান গুরুত্ব পাচ্ছে।
আরও পড়ুন
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
কমতে শুরু করেছে কুড়িগ্রামের নদীর পানি, ভাঙন আতঙ্কে মানুষ
দিনাজপুরে কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় নিহত ২