নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনা মহামারীতে জর্জরিত দুটি বছর পার করলো বিশ্ববাসী। করোনা যদিও এখনো বিশ্ব থেকে বিদায় নেয়নি। নব নব রূপে বিশ্বকে ছোবল মারছে। সর্বশেষ করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রন বিশ্বকে করে তুলেছে শঙ্কিত। অনেক দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে। বিশেষকরে সদ্য সমাপ্ত হওয়া বছরে পণ্যবাজারে চলেছে নানা উত্থান-পতন। পণ্যবাজারের এ অস্থিতিশীলতায় নেতৃত্ব দিয়েছে বিদ্যুৎ খাতের জ্বালানি। মূলত বছরজুড়ে সরবরাহ সংকটকে পণ্যবাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। নতুন বছরে বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও তা স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছবে বলে প্রত্যাশা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কাটতে পারে সরবরাহ-সংক্রান্ত জটিলতা।
২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতি অনেকে স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠতে ধরে, যে স্বাস্থ্যহানিটা ঘটেছিল ২০২০ সালে। তবে ২০২১ সালে যে সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দেয় তা হলো পণ্য সরবরাহ ঘাটতি। মানুষের দোরগোড়ায় পণ্যসেবা পৌঁছানো হয়ে উঠে বেশ কঠিন। আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে জাহাজ ভাড়া। পণ্যসামগ্রী বন্দর পর্যন্ত নিয়ে যেতেও গুনতে হয়েছে অতিরিক্ত অর্থ। অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাঁচামাল ও উৎপাদন উপকরণের দাম। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ব্যয় কয়েক গুণ বেড়েছে।
২০২১ সালে পণ্যচাহিদা ছিল তুঙ্গে। নতুন বছরেও পণ্যচাহিদা ভালো থাকবে বলে ধারণা করছে বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, নতুন এ বছরেও পণ্যের চাহিদা বিদায়ী বছরের মতো বলিষ্ঠ থাকবে। পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াও অব্যাহত থাকবে। ফলে ২০২২ সালেও পণ্যের দাম বাড়বে। তবে ২০২১ সালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির অবসান ঘটবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
২০২১ সাল ছিল নানা কারণে সমালোচিত। তবে অন্যতম কারণ হলো ব্যাপক হারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ ও আগামী বছরগুলোতেও পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়বে। কিন্তু ২০২১ সালে মূল্যবৃদ্ধির গতি ছিল অস্বাভাবিক। আগামী বছরগুলোয় দাম বাড়লেও তা স্বাভাবিক পর্যায়েই থাকবে।
জানা যায়, বিদায়ী বছরে সর্বাধিক বেড়েছে জ¦ালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম। ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে ইউটিলিটি খাত। বেইজিং থেকে শুরু করে ব্রাসেলস; বিশ্বের সব প্রান্তের ভোক্তাদের মাঝেই মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে চাপ বেড়েছে মূল্যস্ফীতির।
তবে আশার আলো এই যে ধারণা করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারে চলমান অস্থিরতা নতুন বছরে অনেকটাই প্রশমিত হওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। বেশির ভাগ পণ্যের গড় দাম পূর্ব বছরের তুলনায় কমে আসতে পারে। তবে নভেল করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রভাব দীর্ঘ হলে বাজার আবারো অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ পূর্বাভাস দিয়েছে পণ্যবাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ফিচ সলিউশন।
বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশির ভাগ পণ্যের সরবরাহ বাড়ছে। কিন্তু এসব পণ্যের চাহিদা ধীরে ধীরে কমে আসতে পারে। ফলে বাজারে বিদ্যমান ঘাটতির অবসান ঘটবে। তৈরি হতে পারে বড় ধরনের উদ্বৃত্ত।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে সৃষ্ট সংকটের কারণে পণ্যবাজারে বিপর্যয় নামে। বিশ্বজুড়ে বিধিনিষেধ আরোপের ফলে পণ্যবাহী কার্গো বন্দর অবধি পৌঁছতে পারেনি। সদ্য সমাপ্ত হওয়া বছরের শুরু থেকে মহামারীর প্রভাব ও বিধিনিষেধ শিথিল হতে থাকে। গতিশীল হয়ে ওঠে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা। এ কারণে জ¦ালানি, ধাতব, খাদ্যশস্যসহ সব পণ্যেরই চাহিদায় উল্লম্ফন দেখা দেয়। কিন্তু সমান তালে বাড়েনি সরবরাহ। এ পরিপ্রেক্ষিতে লাফিয়ে বাড়ে পণ্যের দাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য কিনতে হিমশিম খেতে হয় ক্রেতাদের।
তবে ফিচ সলিউশন নতুন বছরের জন্য আশার বাণী শুনিয়েছে। তাঁদের গবেষণা অনুযায়ী, ২০২২ সালে সব ধরনের পণ্যের গড় মূল্যসূচক ৭ দশমিক ৯ শতাংশ কমতে পারে। চলতি বছর মূল্যসূচক আগের বছরের তুলনায় ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। মোট ২৭টি প্রধান পণ্যদ্রব্যের মধ্যে ১৯টি বা ৭০ শতাংশ পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে লৌহজাত পণ্য (আকরিক লোহা, ইস্পাত), জ¦ালানিপণ্য প্রাকৃতিক গ্যাস (যুক্তরাজ্যের বাজার আদর্শ) ও তাপীয় কয়লা এবং ভোজ্যতেলের (পাম অয়েল, সয়াবিন) দাম সবচেয়ে বেশি কমতে পারে। তবে এশিয়া অঞ্চলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি হাবে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং টিন ও লিথিয়ামের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
করোনা মহামারীর তান্ডবে কৃষিপণ্যের মূল্যও বেড়ে গিয়েছিল অনেক। নতুন বছরে কৃষিপণ্যের দামেও নিম্নমুখী ধারার সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংক আইএনজির আর্থিক গবেষণা সংস্থা আইএনজি থিংকের হেড অব কমোডিটিজ ওয়ারেন প্যাটারসন বলেছেন, ২০২২ সালে আবহাওয়া স্বাভাবিক ও অনুকূলে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কৃষিপণ্যের ফলন বাড়বে। ফলে চলতি বছর খাদ্যপণ্যের দাম এক দশকের সর্বোচ্চে উঠলেও আগামী বছর তা কমবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে ফিচের কান্ট্রি রিস্ক দলের পূর্বাভাস বলছে, আগামী বছর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি আসতে পারে। প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছবে বলে প্রত্যাশা দলটির। ২০১৫-১৯ সাল পর্যন্ত এ হার ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও চীনের অর্থনীতির চাকার গতি শ্লথ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চলতি বছর চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ হলেও আগামী বছর তা কমে ৫ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়াতে পারে।
নতুন বছর শুভ বারতা দিয়েই শুরু হল এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। করোনা মহামারী এ বছর বিশ্ব থেকে বিদায় নিবে বলে ইতোমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় তা উঠে এসেছে। পাশাপাশি আশা করা যায় বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা দূরীভূত হবে। পণ্যবাজারে ফিরে আসবে স্বস্তি।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে চিংড়ির রফতানি পরিমাণ কমছে ধারাবাহিকভাবে
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ