April 26, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, March 31st, 2023, 9:36 pm

বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শিকারীরা, বন্ধ হচ্ছে না সুন্দরবনে হরিণ শিকার

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সুন্দরবনে আবারও সক্রিয় হয়েছে হরিণ শিকারিরা। প্রতিনিয়ত গভীর সুন্দরবন থেকে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে চক্রটি। বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যেও তারা থেমে নেই। জানা যায়, পশ্চিম সুন্দরবনের কয়েকটি এলাকায় একাধিক চোরাশিকারি চক্র সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকার করে। এদের একদল থাকে সুন্দরবনের ভেতরে, আরেক দল পরিবহন ও বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। চড়া দামে হরিণের মাংস বিক্রির জন্য ক্রেতাদের কাছে জীবন্ত হরিণ নিয়ে তাদের সামনেই জবাই করা হচ্ছে। আবার বনের মধ্যে জবাই করা হরিণের ছবি-ভিডিও অনলাইনে পাঠানো হচ্ছে বাইরের ক্রেতাদের কাছে। যে কারণে অনেকের কাছে হরিণের মাংসের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। এই চক্রের সদস্যরা বনবিভাগরে কাছে ধরা পড়লে বেরিয়ে আসছে এরকম ভয়াবহ এই তথ্য। বনবিভাগ সাতক্ষীরা রেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, বনবিভাগের কাছে হরিণ শিকারিদের ১০৮ জনের একটা তালিকাও রয়েছে। তার মধ্যে কোবাদক স্টেশনে ৩০ জন, বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনে ৪২ জন, কদমতলা স্টেশনে ২০ জন, কৈখালী স্টেশনে ১৬ জন রয়েছেন। তালিকা ছাড়াও আরও অনেকে হরিণ শিকারের সঙ্গে জড়িত বলেও জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন ক্রেতারা। জানা গেছে, প্রতিকেজি হরিণের মাংসের মূল্য চাওয়া হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। আর আস্ত একটি জীবিত হরিণের দাম চাওয়া হয় ১৫ হাজার টাকা। এ বিষয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা এলাকার বাসিন্দারা জানান, সেখানে অনেকেই চোরাইভাবে বন থেকে হরিণ শিকার করে বিক্রি করছে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে উল্টো তারাই সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলে না। তারা বলেন, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবন থেকে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে আসছে। সম্প্রতি গ্রামবাসী এই চক্রের এক সদস্যকে হরিণের মাংসসহ আটক করে বনবিভাগের কাছে দেয়। এরপর তাদেরকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়। জানা গেছে, এই চক্রের সদস্যরা অনলাইনে ছবি দেখিয়ে কাস্টমার সংগ্রহ করে। এ ছাড়া স্থানীয় অনেকের কাছে তারা নিয়মিত হরিণের মাংস বিক্রি করে। অভিযোগ রয়েছে, বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে, আবার কখনও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে বনে ঢুকছে শিকারিরা। ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে বিভিন্ন কৌশলে এ হরিণের মাংস খুলনা-বাগেরহাট এমনকি ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছে নানা দামে। তবে বেশি দামে বিক্রি হয় চামড়া। আর এভাবে বিক্রি করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে পথে ঘাটে ধরা পরে দুই একজন শিকারি। ধরা পড়া ব্যক্তিদের কিছুকিছু ক্ষেত্রে ছেড়ে দিয়ে অর্থ বাণিজ্য করছে কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও পুলিশ। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধিও এসব শিকারি চক্রের কাছ থেকে মুনাফা লুটছেন বলে অভিযোগ আছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পেশাদার হরিণ শিকারিদের বিশেষ সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের সঙ্গে থাকে এজেন্ট ব্যবসায়ীরা। এসব এজেন্টের মাধ্যমে কখনও অগ্রিম অর্ডারে, আবার কখনও তাৎক্ষণিকভাবে মাংস এনে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হচ্ছে। সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা বলেন, সুন্দরবন থেকে প্রতিনিয়ত হরিণ শিকারের কারণে সুন্দরবনের প্রাণী বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। অচিরেই যদি হরিণ শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা যায় তাহলে অন্য অনেক প্রাণির মতো এই বন থেকে হরিণও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে বন কর্মকর্তাদের দাবি, হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। র‌্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বন বিভাগের নিয়মিত টহলের কারণে হরিণ শিকারের সুযোগ কম। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও সেটা আগের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় এখন মাংসসহ হরিণশিকারি বেশি ধরা পড়ছেন বলে জানান তাঁরা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে পাঁচারকারীদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী নিধন আইনে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু কোথাও এই শিকারি চক্রের মূল হোতাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। হরিণ শিকার ও পাঁচার রোধে আমরা সব সময় সতর্ক রয়েছি। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে হরিণের মাংসসহ পাঁচারকারীদের গ্রেপ্তার করছি। তবে আগের তুলনায় হরিণ শিকার অনেকটাই কমে এসেছে। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্সে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। হরিণ শিকারের মূল হোতাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছি। বন কর্মকর্তারা বলেন, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার বিধিমালা-২০২০ অনুমোদনের ফলে এখন চোরা শিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য প্রদানে উৎসাহিত হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বাঘের চামড়াসহ আটক করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে তথ্য প্রদানকারীকে ৫০ হাজার টাকা ও সুন্দরবনের বাইরে বাঘের চামড়াসহ আটক করার তথ্য প্রদানকারীকে ২৫ হাজার টাকা, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে হরিণের চামড়াসহ আটক করার সহায়তাকারীকে ২০ হাজার টাকা ও সুন্দরবনের বাইরে হরিণের চামড়াসহ আটক করায় সহায়তাকারীকে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তথ্য প্রদানকারীর নিরাপত্তা ও তথ্য গোপন রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাদের দাবি, সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী শিকার বাড়েনি। আগে বণ্যপ্রাণীর অংশ বিশেষ উদ্ধার হতো। আসামি আটক হতো না। এখন পুরস্কার ঘোষণার কারণে বন্যপ্রাণীর অংশসহ আসামি আটক হচ্ছে। এ কারণে মনে হচ্ছে বন্যপ্রাণী শিকার বেড়েছে। নতুন বিধিমালার পর মানুষের সচেনতা বেড়েছে। তাই হরিণের মাংসসহ আটকের মাত্রা বেড়েছে। সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা এম কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, হরিণ শিকারিদের ধরতে সরকারিভাবে পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয়দের মাধ্যমে তথ্য পেলেই তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো হচ্ছে। কোনো অপরাধীকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, এরইমধ্যে কয়েকজন হরিণ শিকারিকে আটক করে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনকে নিরাপদ করতে ২০১২ সালে টাস্কফোর্স গঠনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল অনেক বেড়েছে। এতে বনে অপরাধ অনেক কমে এসেছে। হরিণ শিকারের অন্যতম উৎস ছিল জলদস্যুরা। মূলত তাঁরাই হরিণ শিকার করে খেতেন। কিন্তু সুন্দরবন এখন বনদস্যুমুক্ত হওয়ায় হরিণ শিকার অনেক কমে গেছে।