নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাঁধের নাজুক অবস্থায় দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলো মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রতি বছরই বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু জোড়াতালি দিয়ে বাঁধের মেরামত কাজ করা হয়। ফলে দুর্যোগে দুর্বল বাঁধ সহজেই ভেঙ্গে পড়ে। উপকূলীয় এলাকায় এমনিতেই বৃষ্টি বেশি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রাথমিক ধাক্কাটাও উপকূল অঞ্চলকে সহ্য করতে হয়। সেজন্যই লোকালয়ে নোনাজল ঠেকাতে স্থানে স্থানে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য বাঁধ। কিন্তু প্রতি বছর বর্ষা এলেই ওসব নদীরক্ষা বাঁধে ফটল দেখা দেয়। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ এলে দুর্বল বাঁধ ভেঙে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি। অভিযোগ রয়েছে, বাঁধগুলোর এমন পরিণতির কারণ মূলত সংস্কারের নামে লুটপাট। পাউবো এবং উপকূলীয় এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় দুর্যোগের পর প্রতিবারই টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি ওঠে এবং প্রতিশ্রুতিও মেলে। কিন্তু উপকূল রক্ষায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ বাস্তব রূপ পায় না। ফলে উপকূলবাসীর ভোগান্তিও শেষ হয় না। প্রতি বছরই বেড়িবাঁধ ভেঙে বাড়িঘর ও ফসলি জমি নোনাপানিতে তলিয়ে যায়। ডুবে যায় এলাকার অসংখ্য মাছের ঘের। তাতে বছরে কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। দেশের ১৩ জেলায় ষাটের দশকে ৫ হাজার ৮১০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় ১৩৯টি পোল্ডার বা বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার ৫২ বছরে নতুন আর কোনো পোল্ডার তৈরি হয়নি। পাকিস্তান আমলের ওসব বাঁধ সংস্কার আর পুননির্মাণেই অর্ধশত বছর কেটে গেছে। ওসব বাঁধের নকশাও মান্ধাতা আমলের। উচ্চতা মাত্র ১০ ফুট। অথচ সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ১২-১৫ ফুট ওপর দিয়ে বয়ে এসেছে। ফলে এখনো অরক্ষিত ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখার প্রায় ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা। সূত্র জানায়, উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রায় প্রতি বছরই পাউবো কোনো না কোনো প্রকল্প হাতে নেয়। সরকারি সংস্থাটি জরুরি সংস্কারের নামে দরপত্র ছাড়াই পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়। তারা আবার অর্ধেক মূল্যে স্থানীয় সাব-ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করে। লাভ রেখে স্থানীয় ঠিকাদারও ওই কাজ পরবর্তী সময়ে শ্রমিক সর্দারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এভাবে কয়েক হাত ঘুরে বাঁধ মেরামতে প্রকল্পের মূল টাকার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ ব্যয় হয়। এমনকি লাভের আশায় অপ্রয়োজনীয় স্থানেও সংস্কার প্রকল্প নেয়া হয়। চলতি অর্থবছরেও বিভিন্ন স্থানে একইভাবে বাঁধ মেরামতের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। নামমাত্র কাজ করে পাউবোর অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ওই টাকা পকেটে ভরছে। খুলনার কয়রা উপজেলা কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা- তিনটি নদ-নদীর ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ঘেরা। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনে প্রতি বছরই ওই এলাকার হাজার হাজার বসতি প্লাবিত হয়। জরুরি কাজের নামে বিগত ১০ বছরে কয়রার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ বাবদ ১৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার টাকারও বেশি খরচ দেখানো হয়েছে। জোড়াতালিতেও বাঁধ সংস্কারের নামে যেটুকু কাজ হয়, সেখানেও রয়েছে অর্থ লুটপাটের অসাধু চক্র। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে খুলনার কয়রা উপজেলার দুটি পোল্ডারে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ১৮টি স্থান নির্ধারণ করা হয়। সেগুলো মেরামতের জন্য সরকার ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু কোনো দরপত্র ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বেড়িবাঁধের চার স্থানের কাজ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবি, চারটি স্থানে ১ হাজার ২০ মিটার বাঁধে রিং-ডাইক ও অস্থায়ী ঢাল সংরক্ষণের কাজ করা হয়েছে। এর জন্য বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ১৬ লাখ ২২ হাজার টাকা। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রমিক সর্দাররা জানান ওই কাজ মাত্র ২০ লাখ টাকায় শেষ করা হয়েছে। চারটি স্থানের মধ্যে দুটিতে কোনো মাটির কাজই হয়নি। বালিভর্তি সামান্য কিছু জিও ব্যাগ বাঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, সারা দেশের উপকূলীয় বাঁধের চিত্র প্রায় একই। অথচ উপকূলীয় জনপদের মানুষের জানমাল রক্ষা করতে হলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা ছাড়া বিকল্প নেই। তা না হলে প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকাই কেবল অপচয় হবে। মানুষের কোনো উপকারে আসবে না। সরকারি হিসাবে সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-১ ও ২-এর অধীনে বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ রয়েছে অন্তত ৩০ কিলোমিটার। এর পরিমাণ আরো অনেক বেশি ছিল। এরইমধ্যে অনেক এলাকার বাঁধ সংস্কার করা হয়েছে এবং কিছু অংশের কাজ চলমান। জেলার ছয়টি উপজেলায় পাউবোর অধীনে বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৭৯ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বা আংশিক ঝুঁকিপূর্ণ ২৫ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। কিছু এলাকায় সংস্কারের কাজ চলছে। আর সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয়ের অধীনে প্রায় ৪০০ কিলোমটাির বেড়িবাঁধ রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি পোল্ডারে প্রায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কারকাজ চলছে। তাছাড়া বঙ্গোপসাগর, খাপড়াভাঙ্গা নদী, পায়রা নদী, আগুনমুখা নদী ও তেঁতুলিয়া নদীবেষ্টিত সর্বদক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীবাসীকেও ঝড়-বৃষ্টির সময় নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। ওই জেলায় মোট পোল্ডার রয়েছে ৩৬টি। ১ হাজার ৩৩৬ দশমিক ৪২ কিলোমিটার বাঁধের ৬৯ দশমিক ৬০৪ কিলোমিটারই চরম ঝুঁকিপূর্ণ। আর লক্ষ্মীপুরের পাঁচ উপজেলার মধ্যে রামগতি, কমলনগর, রায়পুর ও সদরের আংশিকসহ চারটিই মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষা। তবে গত তিন দশকে সবচেয়ে বেশি ভাঙনের কবলে পড়েছে রামগতি ও কমলনগর। নদীতে বিলীন হয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাসহ প্রায় ২৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ভিটেমাটি হারিয়ে বাস্তুহারা হয়েছে লক্ষাধিক উপকূলীয় বাসিন্দা। মেঘনার ভয়াবহ ভাঙন থেকে এ দুই উপজেলাকে রক্ষায় ৩ হাজার ৮৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়বে। ঘন ঘন নিম্নচাপ আর জোয়ার-ভাটার খেলায় উপকূলে চড়বে নোনাপানির আগ্রাসন। এ থেকে মুক্তির জন্য উঁচু ও মজবুত বাঁধই একমাত্র ভরসা। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাঁধ নির্মাণ বা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এতে সাধারণ জনগণের ক্ষতি প্রশমনের চেয়ে প্রভাবশালীদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যটাই বেশি থাকে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি