November 18, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, March 18th, 2024, 9:20 pm

ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ চাঁদা দাতা ‘লটারি কিং’

অনলাইন ডেস্ক :

ভারতের ‘লটারি কিং’ তার কোম্পানিকে নিয়ে দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ চাঁদা দাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। নির্বাচনী বন্ড নামের একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যারা চাঁদা দিয়েছে তাদের সবার উপরে আছেন তিনি। সদ্য বাতিল করা এই প্রক্রিয়ায় ‘লটারি কিং’ সান্তিয়াগো মার্টিনের সংস্থা গেমিং এন্ড হোটেল সার্ভিসেস ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে চাঁদা দিতে ব্যয় করেছে ১৩৬৮ কোটি ভারতীয় রুপি (১৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার) । এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে থাকা চাঁদা দাতার তুলনায় তারা ৪০ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করেছে।

২০১৭ সালে সরকারি উদ্যোগে চালু হওয়া নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে দাতার পরিচয় ও অর্থের পরিমাণ গোপন রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি বা কোম্পানি স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের আর্থিক বন্ড কিনে সেটি পছন্দমতো দলকে দিতে পারতেন। আর রাজনৈতিক দলটি তখন বন্ড ব্যাংকে জমা দিয়ে নগদ অর্থ তুলে নিতে পারতো। এই প্রক্রিয়া ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলোকে বেনামে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।

গত বৃহস্পতিবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে নির্বাচনী বন্ডের ক্রেতা ও যে দলগুলো সেসব বন্ড পেয়েছে তার তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকাতেই শীর্ষ চাঁদা দাতা হিসেবে সান্তিয়াগো মার্টিন ও তার কোম্পানির নাম এসেছে। তবে কোন দাতা কোন দলকে চাঁদা দিয়েছে তথ্যে তার বিস্তারিত প্রকাশ পায়নি। শুধু কোন দাতা কতো অর্থ চাঁদা দিয়েছে আর কোনো দল কতো পেয়েছে সেসব তথ্য সামনে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি সার্বিকভাবে সবচেয়ে বেশি চাঁদা গ্রহণকারী দল।

রয়টার্স জানিয়েছে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলেও এই প্রক্রিয়ায় দেওয়া চাঁদাকে অবৈধ বলেনি। এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ চাঁদা দিয়ে মার্টিন (৫৯) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যিনি তরুণ বয়স থেকে লটারি টিকেট বিক্রি করতে করতে লটারি থেকে শুরু করে রিয়েল এস্টেটের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চটকদার ও কমনীয় ভঙ্গিতে কথা বলায় দক্ষ মার্টিন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতি দলের মধ্যে তার প্রচুর বন্ধু তৈরি করে নিয়েছেন।

রাজনীতিকদের পেছনে তিনি দু’হাত খুলে খরচ করেন। নিজের ব্যবসার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নেতাদের দামি দামি উপহার দিতে থাকেন তিনি। মার্টিন নিজের দরিদ্র পরিবারকে সাহায্য করতে মিয়ানমারে শ্রমিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তারপর ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে ভারতে ফিরে আসেন তিনি। তিনি দেশটির তামিলনাডু রাজ্যের কোয়েম্বাটোর শহরে নিজের ব্যবসায়ীক যাত্রা শুরু করেন বলে ভাষ্য অলাভজনক মার্টিন চ্যারিটেবল ট্রাস্টের। কোয়েম্বাটোরে তিনি দুই অঙ্কের যে লটারি শুরু করেন তা কিছুদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

দরিদ্র লোকজন এই লটারির মাধ্যমে রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। ব্যবসা বাড়তে শুরু করলে মার্টিন ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতেও ব্যবসা সম্প্রসারিত করেন। পরবর্তীতে ভারতের প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটানেরও তার লটারি ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়। তাদের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এই দুই দেশে নিজেদের লটারি বিতরণে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য আছে। রুশ লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির উপন্যাস ‘মা’ অবলম্বনে তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রীর লেখা চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে নির্মাণ করা একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে ২০ কোটি রুপি ব্যয় করেন তিনি। ছবিটি ২০১১ সালে মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু ওই বছরই তামিলনাডুর ক্ষমতাসীন দল বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর মার্টিনের ওপর দুর্ভোগ নেমে আসে।

তিনি ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। তাদের বিরুদ্ধে লটারি কেলেঙ্কারির ৩২টি মামলা করে কেন্দ্রীয় পুলিশ। এগুলোর মধ্যে সিকিমে অন্তত ৪৫০০ কোটি রুপির একটি কেলেঙ্কারির অভিযোগও ছিল। অবৈধ লটারি বিক্রি ও প্রতারণা, ভূমি আত্মসাৎসহ ১৪টি মামলায় যোগসাজশ থাকায় বেশ কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গে তার আট মাসের কারাদ- হয়েছিল। এসব মামলার কোনোটিতেই তাকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়নি, এগুলোর কোনো কোনোটি এখনও স্থগিত হয়ে আছে। ২০১২ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান।

তার সমস্যা বেড়ে গেলে মার্টিনের পরিবার সামনে এসে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। ২০১৪ সালে মোদীর নির্বাচনী প্রচারণার সময় মার্টিনের স্ত্রী মোদীর পক্ষে নামেন। ওই বছরই নির্বাচনে জিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসে, মোদী প্রধানমন্ত্রী হন। এর পরের বছর মার্টিনের বড় ছেলে চার্লস বিজেপিতে যোগ দেন। পরের বছরগুলোতে কর কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো মার্টিনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তল্লাশি চালায়। তার বিরুদ্ধে চলা মামলাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় সম্পত্তি জব্দ করে। ভারতের আর্থিক অপরাধের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের করা সম্পত্তি জব্দের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন তিনি, কিন্তু গত বছর তা খারিজ হয়ে যায়।

ভারতের অর্থ পাচার আইনের অধীনে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফিউচার গেমিং ও মার্টিনের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও ১৫টি কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। সংস্থাটি বলেছে, “তারা লটারি বিক্রির মাধ্যমে করা আয় পুরোপুরি জমা না দিয়ে লটারি ইস্যু করা রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলে অভিযোগ আছে।” মার্টিনের কোম্পানিগুলো অবিক্রিত টিকেটে পুরস্কার ছিল, এমন ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে পুরস্কারের অর্থ ধরে রেখে লটারি আইন লঙ্ঘন করেছে এবং তারা তথ্যে হেরফের ঘটিয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। মার্টিন ও তার প্রতিষ্ঠানগুলো দাবি করেছে, তারা কোনো অন্যায় করেনি। মার্টিনের বাণিজ্যিক সংস্থা মার্টিন গ্রুপ অক্টোবরে জানিয়েছিল, তার গোষ্ঠী ও সংস্থাগুলো আইন মেনে চলে এবং মার্টিন ২০০৩ সালে ভারতের শীর্ষ করদাতা হয়েছিলেন।