এম. মছব্বির আলী, মৌলভীবাজার:
এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকিতে দেখা মিলেছে টর্নেডো বা জলস্তম্ভের। শনিবার বিকেলে কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলা থেকে স্থানীয় ব্যক্তিরা এ টর্নেডো দেখতে পায়। ৫০ বছরের মধ্যে হাওরে এমন দৃশ্যের দেখা মেলেনি বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী। এমন দৃশ্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাউর হলে মূহুর্তে তা ভাইরাল হয়ে পড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মুঠোফোনে ধারণকৃত ওই ভিডিও নিয়ে আলোচনা এখন দেশ বিদেশসহ সর্বত্র। সাগরে এমন দৃশ্য দেখা গেলেও তা হাওর এলাকায় দেখা মিলে কম। নিকট অতীতে এমন দৃশ্যের দেখা মিলেছে কিনা তা নিয়ে যেমন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তেমনি ওই দৃশ্যের বিজ্ঞান সমেত বক্তব্যও খোঁজছেন অনেকেই। তবে দীর্ঘদিন থেকে ভয়াবহ বন্যায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতার দুর্ভোগে থাকা হাকালুকি হাওর তীরের বাসিন্দারা বলেছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে এটা আল্লাহর কুদরত ও রহমত। টর্নেডোর পর ওই এলাকায় অনেক পানি কমেছে। ২৩ জুলাই শনিবার সন্ধ্যার আগমূহুর্তে হঠাৎ করে হাকালুকি হাওরের চাতলাবিল ও বাইলাকান্দির মধ্যস্থলে জল টর্নেডো শুরু হয়। এমন দৃশ্য সরাসরি অবলোকন করেন ও নিজেদের মুঠোফোনে তা ধারণ করেন বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলার হাওর পাড়ের মানুষ।তারা বলেন, হঠাৎ হাওরের জল কুন্ডলির ন্যায় ঘূর্ণন গতিতে আকাশের দিকে উঠে কালো মেঘের ভেতর গিয়ে প্রবেশ করে।
এ অবস্থার স্থায়ীত্বকাল ছিল প্রায় ১৫ মিনিট। ওই সময় হাওরের কয়েক কিলোমিটার এলাকা থেকে ওই স্থানে ছুটে যাওয়া পানির স্রোত ছিলো প্রবল। হাওর পাড়ের মানুষ প্রথমবারের মতো সরাসরি টর্নেডো প্রত্যক্ষ করেন ও অনেকেই মুঠোফোনে তা ভিডিও ধারণ করেন। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ওই ভিডিও ভাইরাল হয়। প্রথম দিকে অনেকে ওই ভিডিও নিয়ে নানা সন্দেহ পোষণ করলেও পরে তা প্রমাণিত হয় ওই ভিডিওটি হাকালুকির। হাওর তীরের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার সন্ধ্যার কিছু আগে হঠাৎ দেখেন হাওরের ভেতর পানি ও আকাশ এর মধ্যে হাতির শুঁড়ের মতো কিছু একটা ঘূর্ণন খাচ্ছে। অনেকেই এমন দৃশ্য দেখে ভয় পান। ঘূর্ণন দুর্বল হয়ে আসার পরই শুরু হয় ঝড় ও বৃষ্টি।
তবে অনেকেই টর্নেডোর বিজ্ঞান সমেত বক্তব্য তুলে ধরেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তারা সংজ্ঞা দিচ্ছেন টর্নেডো এক ধরনের ঝড়, যা বায়ুস্তম্ভের আকারে সৃষ্ট প্রচন্ড বেগে ঘূর্ণায়মান ঝড় যা মেঘ (সাধারণত কিউমুলোনিম্বাস, ক্ষেত্রবিশেষে কিউমুলাস) এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের সাথে সংযুক্ত থাকে। টর্নেডোর আকৃতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি দৃশ্যমান ঘনীভূত ফানেল আকৃতির হয়। যার চিকন অংশটি ভূপৃষ্ঠকে স্পর্শ করে এবং এটি প্রায়শই বর্জ্যের মেঘ দ্বারা ঘিরে থাকে। আবহাওয়া বিজ্ঞানের শব্দকোষ (Glossary of Meteorology) অনুযায়ী, টর্নেডো হল প্রচন্ড বেগে ঘূর্ণনরত একটি বায়ুস্তম্ভ, যা ভূপৃষ্ঠের সংস্পর্শে একটি কিউমুলিফর্ম মেঘ থেকে ঝুলন্ত বা এর নীচে থাকে, এবং প্রায়শই (কিন্তু সবসময় নয়) একটি ফানেলাকৃতির মেঘ হিসেবে দৃশ্যমান থাকে। টর্নেডো তৈরি হয় অনেকটা কালবৈশাখীর নিয়ম মেনে।
সমুদ্র থেকে গরম জলীয় বাষ্প ভরা বাতাস সমতলে ঢুকে ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে থাকে। এক সময়ে তা ঠান্ডা বাতাসের সংস্পর্শে চলে আসে। আর তার থেকেই তৈরি হয় উল্লম্ব মেঘ। উল্লম্ব মেঘ উচ্চতায় বাড়তে থাকে এবং এক সময় সেই মেঘ ভেঙে গিয়ে তৈরি হয় কালবৈশাখী। টর্নেডো তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটাও প্রায় একই রকম। তবে এ ক্ষেত্রে বায়ুপ্রবাহের জটিলতায় দীর্ঘকায় উল্লম্ব মেঘের ভিতরে ঘূর্ণি তৈরি হয়। সেই ঘূর্ণি একটি সরু ফানেলের আকারে (মনে হয় যেন হাতির শুঁড়) নেমে আসে মাটির কাছাকাছি। আর মাটি ছুঁয়েই সেই দৈত্যাকৃতি ঘূর্ণায়মান ফানেল তার কেন্দ্রের দিকে সব কিছু টেনে নেয়। ১৯৮৯ সালের ২৬ এপ্রিল মানিকগঞ্জ জেলায় শক্তিশালী টর্নেডোতে মারা গিয়েছিলেন ১৩শ’ মানুষ।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী জাপানের কাইটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের প্রফেসর ড. শি থাইচি হায়াসিসের বরাত দিয়ে তিনি এ বিষয়ে বলেন, এটি এক ধরনের টর্নেডো। মূলত টর্নেডোর কারণে এ রকমটি হয়ে থাকে। তবে এ ধরনের ঘটনা সচরাচর কমই দেখা যায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জল দিয়ে মোড়ানো বাতাসের তৈরি টর্নেডোর ফলে এটি সৃষ্টি হয়। জলভাগের ওপর শক্তিশালী টর্নেডো সৃষ্টি হলে প্রবল বেগে ঘূর্ণমান বায়ুর টানে জলভাগের জল টর্নেডোর কেন্দ্র বরাবর স্তম্ভাকারে ঘুরন্ত অবস্থায় ওপরে উত্থিত হয়। একে জলস্তম্ভ (Water Spout) বলে। তবে গ্রামাঞ্চলে এটি ‘মেঘশূর’ নামে পরিচিত।
দেখতে টর্নেডোর মতো হলেও টর্নেডোর সঙ্গে এর মৌলিক পার্থক্য উপাদানে। টর্নেডোতে থাকে বায়ু আর জলস্তম্ভে বায়ুর পরিবর্তে থাকে পানি। জলস্তম্ভ সাধারণত পানিতেই থাকে বলে জনপদে আহামরি ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালাতে পারে না। আর স্থলভাগের স্পর্শে আসলে এটি গুঁড়িয়ে যায়।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু, আহত ২
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি