November 18, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, January 31st, 2022, 12:31 pm

তেঁতুলিয়ায় সৌরভ ছড়াচ্ছে ‘টিউলিপ’

শীতের জেলা পঞ্চগড় রাঙিয়ে তুলেছে নানা রঙের টিউলিপ ফুল। সীমান্তবর্তী এই জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার সারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামে টিউলিপ ফুল উৎপাদিত হচ্ছে। ৪০ শতাংশ জমিতে এবারই প্রথম রাজসিক সৌন্দর্য এর ফুল টিউলিপ উৎপাদন করেছেন চাষিরা।

পঞ্চগড় জেলায় শীত মৌসুমে তাপমাত্রা কম থাকায় টিউলিপ ফুল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে প্রমাণ করে দিয়েছেন তেঁতুলিয়ার শারিয়াল জোত ও দর্জিপাড়া গ্রামের চাষি মুক্তা বেগম, আনোয়ারা বেগম, সুমি আক্তার, আয়শা বেগম, মোছা. হোসনেয়ারা বেগম, মনোয়ারা বেগম, মোর্শেদা বেগম ও সাজেদা বেগম। তারা সকলেই ইকো সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) নারী সদস্য।

তারা জানান, বাল্ব বা চারার দাম, শেড নেট, ফেন্সিং নেট, রাসায়নিক সার, জৈবসার, কীটনাশক ও শ্রমের মূল্য বাবদ মোট খরচ প্রায় ৩০ থেকে ৩২ লাখ টাকা। ৪০ হাজার টিউলিপ ফুল ১০০ টাকা হারে বিক্রি করতে পারলে ৪০ শতক জমি থেকে মাত্র দুই মাসে ৮ লাখ টাকা আয় করবেন চাষিরা। পরবর্তীতে বছরের অন্য সময়টাতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ফুল চাষাবাদও করতে পারবেন। ফুল বাগানে ক্ষুদ্র পরিসরে বিনোদন পার্ক তৈরি করে পর্যটক ও ফুলপ্রেমিদের জন্য প্রবেশ মূল্য চালু করেছেন। এতে ফুল বিক্রি বাদেও তারা অতিরিক্ত টাকা আয় করতে পারবেন।

শীতপ্রধান অঞ্চল হিসেবে পঞ্চগড়ে টিউলিপ রোপণ ও উৎপাদনে সফল হওয়ায় ভবিষ্যতে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে টিউলিপ রপ্তানির সম্ভাবনা জাগিয়েছেন। ফুল বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হলে আগামী বছর প্রায় ৫ একর জমিতে টিউলিপের চাষ করবেন বলে জানিয়েছেন তারা।

প্রতিদিন দূর-দূরান্তের শত শত প্রকৃতিপ্রেমি শিশু কিশোর, যুবক, নারী-পুরুষ পরিবার পরিজন নিয়ে দলবেধে দৃষ্টিনন্দন টিউলিপ ফুলের অপরুপ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে ভিড় করছেন এসব ফুল বাগানে। নানা ধরনের চোখ ধাঁধানো টিউলিপ দেখে স্থানীয়সহ পর্যটক সকলেই বিস্মিত হয়েছেন।

ফুল চাষিরা জানান, বিদেশে বসন্তকালের ফুল হলেও আমরা এখানে শীতকালেই টিউলিপ ফুল ফুটিয়েছি। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির ১২ কালারের টিউলিপ চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে অ্যান্ট্রাকটিকা (হোয়াইট), ডাচ সানরাইস (ইয়েলো), পারপেল প্রিন্স (পারপেল), টাইমলেস (রেড হোয়াইট শেডি), মিল্কসেক (লাইট পিঙ্ক), বারসেলোনা (ডার্ক পিঙ্ক) নামে রংবেরঙ্গে টিউলিপ ফুলে ভরে উঠেছে বাগান। এছাড়া অ্যাড রেম (অরেঞ্জ), লালিবেলা (রেড). দি ফ্রান্স (রেড), রিপ্লে (অরেঞ্জ), ডেনমার্ক (অরেঞ্জ), স্ট্রং গোল্ডসহ (ইয়েলো) বিভিন্ন প্রজাতির টিউলিপ রয়েছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে সকল কলি ফুলে পরিণত হবে।

তারা জানান, প্রথমদিকে তাদের মনে অজানা ভয় ও শঙ্কা থাকলেও ইএসডিও ও কৃষি বিভাগের পরামর্শে নিজের শ্রম ও মেধা খাটিয়ে ফুল চাষে সফল হয়েছেন। মাত্র ১৬ দিনের পরিচর্যায় ফুলের কলি আসে। ২১ দিনের মধ্যেই ফুল ফুটতে শুরু করে।

চাষিরা বলেন, টিউলিপ চাষের প্রধান প্রতিবন্ধকতা এই ফুলের বাল্ব বা বীজ আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। আপাতত আমাদের দেশে নেদারল্যান্ড থেকে টিউলিপ ফুলের বাল্ব বা বীজ এনে চাষ করতে হচ্ছে। বিদেশ থেকে এ ফুলের বাল্ব আনতে অনেক টাকা শুল্ক দিতে লাগে। শুল্কমুক্ত বাল্ব আমদানি করতে পারলে নজরকারা এ ফুলের চাষ বাড়বে সাথে উৎপাদনও বাড়বে। স্বল্প মূল্যে সহজ শর্তে টিউলিপের বাল্ব সরবরাহ, ফুল চাষে চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ ও আধুনিক প্রশিক্ষণের দাবি জানান চাষিরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সারি সারি শত শত টিউলিপ ফুল ফুটে রয়েছে। একের পর এক প্রজাতির টিউলিপ ফুল ফুটতে শুরু করেছে। অন্যগুলোর কলি বের হয়েছে। ফুলগুলোকে শেডনেটের নিচে ফেন্সিংনেট দিয়ে চারপাশে ঘেরা দিয়ে চাষ করা হয়েছে। কৃষাণ কৃষাণীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন পরিচর্যায়। তারা এখন স্বপ্ন দেখছেন বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষ করার।

ফুল দেখতে আসা দর্শনার্থী জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার আজিজনগর গ্রামের জুয়াইরিয়া বলেন, আমি এর আগে এ ফুলটি দেখিনি। আমাদের এলাকায় প্রথম এ ফুলটি চাষ হয়েছে। বান্ধবীদের সাথে নিয়ে ফুল বাগান দেখতে এসেছি। নানা রঙের বাহারি ফুল দেখে আমরা মুগ্ধ, অভিভূত।

ইকো সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগিতায় তেঁতুলিয়ায় খামার পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রথম টিউলিপ ফুল চাষের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগটি ইতোমধ্যেই সাফল্য পেয়েছে এবং মাঠ পর্যায়ে টিউলিপ চাষ সম্ভব হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি এর মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষীদের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক আয় এবং সম্ভাবনা যেমন অনেকাংশে বেড়ে যাবে একিভাবে পর্যটন শিল্পেও তেঁতুলিয়ার যে বিদ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে যে একটি আধার সেটি আরও সম্প্রসারিত হবে এবং এটি এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে টিউলিপ চাষ আরও বড় আকারে সম্প্রসারিত করার ইচ্ছা রয়েছে। টিউলিপের বাজারজাতকরণের জন্য আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে ফুল ব্যবসায়ীদের প্রকল্প এলাকায় নিয়ে এসে ফুল কেনার বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এছাড়া ইকো ট্যুরিজম গড়ে তোলার বিষয়েও বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, তেঁতুলিয়ার আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে যে টিউলিপ ফুলের চাষ শুরু হয়েছে। ইএসডিও নামে একটি এনজিও কৃষকদের মোটিভেশনের মাধ্যমে শুরু করেছেন। আমরা কৃষি বিভাগ এটির সঙ্গে ইনভল্ব হয়েছি। কৃষকদেরকে মোটিভেশন দেয়া, চাষাবাদ পদ্ধতি এবং রোগবালাই পোকা মাকড় এগুলো সম্পর্কে পরামর্শ অব্যাহত রেখেছি।

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সিনিয়র মহা-ব্যবস্থাপক (কার্যক্রম) ড. আকন্দ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারের উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিকেএসএফ দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে আসছে। এর পাশাপাশি পিকেএসএফ বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চ মূল্যের ফুল ও ফসল চাষাবাদে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আমরা বাংলাদেশের নতুন উদ্ভাবন টিউলিপ চাষের উদ্যোগ নিয়েছি।

তিনি বলেন, আমরা আশা করছি একসময় টিউলিপের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি বাড়াতে পারবো। এজন্য সরকার, পিকেএসএফ, ইএসডিও ও চাষিরা সম্মিলিতভাবে কাজ করছে।

—-ইউএনবি