নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে হারবাল চিকিৎসার নামে প্রতারণা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। হারবাল, হোমিও, আয়ুর্বেদিক বা ইউনানি চিকিৎসার নামে প্রতারণার অভিযোগ উঠছে অহরহ। শত শত কারখানায় নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। চটকদার বিজ্ঞাপন আর আকর্ষণীয় মোড়কে আকৃষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। চটকদার বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়ে ভেষজ ওষুধের নামে নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবন করে মানুষ আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনেক হারবাল প্রতিষ্ঠানের মালিক চিকিৎসকরা রোগীদের আকৃষ্ট করতে নিজেরাই ওষুধের নাম তৈরি করে। বাহারি আর ইসলামি কায়দার নাম দেখে রোগীরা আকৃষ্ট হয়।
একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি, হাকিম, কবিরাজ ও ডাক্তার সর্ব রোগের চিকিৎসক সেজে দীর্ঘদিন থেকেই সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মনীতি উপেক্ষা করে অশ্লীল ভাষায় পত্রপত্রিকা, ডিশ চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার ও যেখানে সেখানে লিফলেট ছড়িয়ে ব্যবসা জোরদার করছে। এতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে পরিবার ও স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীরা। রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে এদের নিযুক্ত লোকজন লিফলেট হাতে হাতে বিলি করে চরম বেকায়দায় ফেলছে পথচারীদের।
বাস ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনে উঠে এরা লিফলেট বিতরণ করে আবার পথচারীদের গায়ে ছুঁড়ে মারে। জনবহুল এলাকা-গুলোয় ভেষজ ওষুধের নামে অসাধু ব্যবসায়ী ও তথাকথিত চিকিৎসকেরা ফুটপাত ও দোকানে ব্যবসা জমিয়েছে। রাজধানীর ফার্মগেট, গুলিস্তান, গাবতলী, সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কাওরানবাজার, মিরপুর, পল্লবীতে ফুটপাতে ১০ টাকা থেকে ১০০ টাকা দামের এমন ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। মূলত দরিদ্ররা এসব ওষুধের ক্রেতা। দেশে রয়েছে ৮শর বেশি ইউনানি, আয়ুর্বেদ, হারবাল ও হোমিও ওষুধ কারখানা। বেশিরভাগেই ওষুধ উৎপাদন ও মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
ভেষজ ওষুধ উৎপাদন দেখতে কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখা যায় সবগুলো কারখানায় চটকদার মোড়কে গ্রাহক আকৃষ্ট করার অভিনব পদ্ধতিতে সাজানো রয়েছে সব পণ্য। গাছ-গাছড়ার হাব দিয়ে ওষুধ উৎপাদনের কথা থাকলেও সেসবের অস্তিত্বও নেই। থরে থরে সাজানো ক্ষতিকর কেমিকেল দিয়েই তৈরি হচ্ছে সব ধরনের ওষুধ। এসব কারখানায় উৎপাদিত হচ্ছে যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, জিনসেং সিরাপসহ অন্তত ৬০টি ওষুধ। আটা-ময়দা দিয়ে হাতেই তৈরি হচ্ছে ক্যাপসুল। এমন রোগ নেই, যার ওষুধ নেই এসব করাখানাগুলোতে।
নিষিদ্ধ রং, আটা, ময়দা, সুজি, চিনিসহ বনের আগাছা ও অচেনা লতা-পাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব নকল ও ভেজাল ওষুধ। বর্তমানে ফেসবুকে এ ধরনের অনুমোদনহীন করাখানাগুলোর সহ¯্রাধিক পেজ আছে। জন্ডিসের ওষুধ থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, লিভার, হাড়ক্ষয়, দৃষ্টিশক্তি, জ¦র, কাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য, পাইলস, কোলেস্টেরল, ওজন কমানো, উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ-কি নেই এসব পেজে! রোগ নিরাময় তো দুরের কথা মানুষ আরো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগছে। ইয়াবা, ভায়াগ্রা, ইডিগ্রা, ভারতীয় যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট গুড়ো করে মিশিয়ে বড়ি ও হালুয়া তৈরি করে হারবাল ওষুধ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। এ ওষুধ খেলে ক্ষনিকের জন্য কাজ হয় যৌন উত্তেজনার।
কিন্তু পরে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। এচিকিৎসা গোপন ব্যাপার তাই প্রতারনার শিকার হলেও অনেকে লোক লজ্জার ভয়ে মুখ খোলেনা। ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রিসে আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে। গ্রিক মনীষী হিপোক্রেটিস, যাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক বলা হয়-তিনিই মূলত এ পদ্ধতির প্রসার ঘটান। দক্ষিণ এশিয়ায় এ চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভব পাঁচ হাজার বছর আগে। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বা অল্টারনেটিভ মেডিসিন বিশ্বের সর্বত্রই স্বীকৃত। গাছগাছড়ার ভেষজ চিকিৎসা থেকে শুরু করে আকুপাংচার, হাইড্রোথেরাপি, অ্যারোমাথেরাপি ইত্যাদি ব্যতিক্রমী চিকিৎসা বিভিন্ন দেশে চালু আছে।
হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ কিংবা ইউনানী পদ্ধতিতে চিকিৎসা তো অনেক দেশে সরকারিভাবে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেই দেয়া হয়। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য রোগীকে সুস্থ করা। তা সম্ভব না হলে উপসর্গগুলো কমানো এবং অবশ্যই কোনো ক্ষতি না করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভেষজ ওষুধ সংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি (ক্রনিক) রোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর। অথচ নিম্নমানের, নকল ও ভেজাল ওষুধ রোগীদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র বলছে, অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিও ও হারবাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশের জোগান দিয়ে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে রপ্তানি করছে।
বর্তমানে ওষুধের এ বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। সুযোগসন্ধানী প্রতারকরা রোগীদের আকৃষ্ট করতে প্রচারপত্র বিলি, কেবল অপারেটরে বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় ফেসবুকে পেজ ও গ্রুপ খুলে বিভিন্ন নামে এসব মানহীন ও নকল ওষুধ বিক্রি করছে। বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক শিল্প সমিতির সদস্যরা বলেন, আয়ুর্বেদিক, ইউনানী ও ভেষজ ওষুধের বাজারের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে অসাধু প্রতিষ্ঠান। রাস্তায় যারা ওষুধ বিক্রি করে তারা শক্তিশালী। না হলে তারা কিভাবে পুলিশ প্রশাসনের সামনে এই কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ প্রস্তুতকারক ও গবেষকদের চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে বৈধ সনদ থাকতে হয়। কোনো ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিক পণ্য বাজারজাতের আগে মানবদেহে তা কতটুকু মাত্রায় কার্যকর এবং এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা করা হয়। মানবদেহে প্রয়োগের আগে প্রাণীদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও হয়। চূড়ান্ত ধাপে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনের পর তা বাজারজাত করা হয়।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম