নিজস্ব প্রতিবেদক:
এবার দেশে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। বর্ষাকাল আসতে এখনো কয়েক সপ্তাহ বাকি। ইতোমধ্যে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৬ জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। সুরমা নদীর পানি উপচে একাকার সিলেট নগরী। তলিয়ে গেছে বোরো ফসলের জমি। তাছাড়া তিস্তা পাড়ের কুড়িগ্রাম, গাইবান্দা, লালমনিরহাট ও রংপুরের চরাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। তাতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে সিরাজগঞ্জ, টঙ্গাইল জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বন্যা বেড়েই চলেছে। গত ৫-৬ বছর ধরে ক্রমেই তা দৃশ্যমান হচ্ছে। ২০২০ সালের বন্য দীর্ঘ ৫২ দিন ধরে চলছে। স্থায়িত্বের দিক থেকেও ওই বন্যা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এবার দেশে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশঙ্কা করছেন। বিশেষজ্ঞ এবং বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভারতের ঢলে পানিতে তলিয়ে গেছে সিলেট অঞ্চল। সুরমা নদীর পানি উপচে একাকার সিলেট নগরী। যতো সময় যাচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির ততোই অবনতি হচ্ছে। তাছাড়া সিলেট-সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকা এখন উজানের ঢলে কুপোকাত। মিনিটে মিনিটে বাড়ছে পানি। দিশেহারা হয়ে পড়েছে মানুষ। পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে সিলেট নগরীতে ১৬টি আশ্রয় কেন্দ্র চালু করেছে সিটি কর্পোরেশন। তাছাড়া টানা বর্ষণে বগুড়ার নদ-নদীতেও বাড়ছে পানি। অসময়ে ওই পানি বৃদ্ধিতে বগুড়ার বৃহত্তম যমুনা, বাঙালি ও করতোয়া নদী পাড়ের নিচু জমির ধান ও মৌসুমি ফসল পচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। গভীর শঙ্কায় রয়েছে বোরো চাষিরা। যমুনায় কালিতলা পয়েন্টে পানি ১২.৪৮ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর বিপদসীমা ধরা হয় ১৬ দশমিক। ওই হিসেবে আপাতত পানি বিপদ সীমার অনেক নিচে রয়েছে। তবে যমুনা নদী বেষ্টিত নদীকূল এলাকায় ৫টি উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের ফসল ডুবে গেছে। তাতে কৃষকদের যেমন নাভিশ্বাস অবস্থা, তেমনি নদী কূলের ভাঙনে ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। যমুনা নদী ক্রমে ফুলে ফেপে উঠছে। ইতোমধ্যে নদী তীরবর্তী কাজীপুর, চৌহালী, শাহজাদপুর, বেলকুচি এলাকায় নদী পাড়ের ভাঙন দেখা দিয়েছে। যমুনার পানি বৃদ্ধির কারণে নদী তীরবর্তী সিরাজগঞ্জ সদর, কাজীপুর নাটুয়ারপাড়া, শাহজাদপুরের জামিরতা, চৌহালীর খাসকাওলিয়া, এনায়েতপুর ও বেলকুচির নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের সব ধরণের উঠতি ফসলের ক্ষতি হয়েছে। একইভাবে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টেও পানি বাড়ছে।
সূত্র জানায়, ঋতু পরিক্রমায় বাংলাদেশে সাধারণত জুন-জুলাই মাসে বন্যা আসে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী গত প্রায় দশ বছর ধরে বছরে দুই ধাপে বন্যা আসছে। প্রথমধাপ জুলাই-আগস্টে এবং দ্বিতীয়ধাপে বন্যা আসে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। তবে এবার ঋতুচক্র বা আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণ সব কিছুকে উল্টে দিয়ে মে মাসে অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে দেশের হাওরাঞ্চল। তাছাড়া ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকতে পারে। তাছাড়া সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। দেশের উত্তরাঞ্চলের ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমার নদীর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত থাকতে পারে। গত কয়েক বছরে বন্যার পানি বৃদ্ধির পরিমাণ ৪টি রেকর্ড ভেঙেছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানি আগের সব রেকর্ড ভেঙে ২০১৬ সালে সবচেয়ে উঁচুতে ওঠে। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে তা উপর্যুপরি রেকর্ডভাঙা উচ্চতায় ওঠে। ২০২০ সালে বন্যার পানি তিস্তা অববাহিকায় বিপদসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। যা ওই অববাহিকার জন্য একটি রেকর্ড। তাছাড়া স্থায়িত্বের দিক থেকেও ২০২০ সালের বন্য দীর্ঘ ৫২ দিন ধরে চলছে। স্থায়িত্বের দিক থেকেও ওই বন্যা ১৯৯৮ সালের পর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, চলতি বর্ষা মৌসুমে বন্যার পরিধি আরো বাড়বে। যা আগের বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞরা এ রকম পূর্বাভাসই দিচ্ছেন। তাদের মতে, পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে এলনিনো অঞ্চলের তাপমাত্রা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় প্রভাব ফেলে। চলতি বছর এলনিনো অঞ্চলের তাপমাত্রার কারণে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বর্ষায় বেশ প্রভাব ফেলবে এবং বন্যার পরিধি বাড়তে পারে।
এদিকে এ ব্যাপারে পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত জানান, বন্যা ঋতুবৈচিত্রের একটি স্বাভাবিক রূপ। বন্যা এদেশকে উর্বর করে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসময়ে যে বন্যা হচ্ছে তা প্রতিকারের জন্য অবশ্যই পূর্ব প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রতি বছরই হাওরাঞ্চল পাহাড়ি ঢলে ডুবছে। হাওর রক্ষায় যে বাঁধ নির্মাণ করা হয় সেগুলো অপরিকল্পিত। প্রতি বছরই বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়াও দেশের নদীগুলো নাব্য হারিয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে বন্যার বিস্তৃতি বাড়ছে। দেশের নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্যান্য সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বন্যা মোকাবিলায় একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, গত এক যুগে মূলত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা বেড়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করছে মানুষ। আর বাংলাদেশে যতো পানি আসছে, তার বেশির ভাগ ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আসছে। ওই পানি মেঘনা দিয়ে পদ্মা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বন্যা বাড়ছে। তাছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয়, হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মিজোরাম প্রদেশে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলও বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন
তিস্তার পানি কমতে থাকলেও বেড়েছে ভাঙন আতঙ্ক
সিরাজগঞ্জে দ্রুত গতিতে বাড়ছে যমুনার পানি
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে আগ্রহী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নাহিদ ইসলাম